P.R. পদ্ধতি (Proportional Representation) বা পিয়ার পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক ও মতামতনির্ভর সম্পাদকীয় কলাম
সম্পাদকীয় কলাম:
P.R. পদ্ধতিতে নির্বাচন: গণতন্ত্রের আরও নিখুঁত ও ন্যায্য রূপ
গণতন্ত্রের সৌন্দর্য তার প্রতিনিধিত্বমূলক কাঠামোর মধ্যেই নিহিত। কিন্তু সেই কাঠামো যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের দখলে চলে যায় এবং সংখ্যালঘুরা থেকে যায় উপেক্ষিত, তাহলে তা আর কতটুকু “জনগণের শাসন” থাকে? এই প্রশ্নটিই আজ বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাবাচ্ছে। আর এরই এক সম্ভাব্য ও কার্যকর উত্তর হিসেবে উঠে আসছে—P.R. (Proportional Representation) বা পিয়ার পদ্ধতি।
P.R. পদ্ধতি কী?:
Proportional Representation (P.R.) বা অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি এক ধরনের নির্বাচনী ব্যবস্থা, যেখানে প্রত্যেক দল বা জোট তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন পায়। এতে কোনো একটি দলের ৩৫% ভোট থাকলে, তারা সংসদের প্রায় ৩৫% আসনই পায়। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের কণ্ঠস্বরও সংসদে শোনা যায়।
এর বিপরীতে আমাদের দেশে প্রচলিত “প্রথম বিজয়ী” (First Past the Post – FPTP) পদ্ধতিতে, যে প্রার্থী বেশি ভোট পায়, সে-ই নির্বাচিত হয়—ভোটের শতকরা হিসাব যতই হোক না কেন। এতে প্রায়ই দেখা যায়, কোনো দল ৩৮-৪০% ভোট পেয়ে ৭০-৮০% আসন দখল করে নেয়, আর বাকিদের প্রায় প্রতিনিধিত্বই থাকে না।
P.R. পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা:
বাংলাদেশের মতো একটি রাজনৈতিকভাবে বৈচিত্র্যময় ও জনগোষ্ঠীর দিক থেকে রঙিন সমাজে P.R. পদ্ধতি হতে পারে গণতন্ত্রের অধিকতর সমতাভিত্তিক রূপ। এতে—
ছোট দলগুলোও ভোটের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব পায়।
জোটভিত্তিক সরকার গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হয়, যা রাজনৈতিক নমনীয়তা ও আলোচনার সংস্কৃতি গড়ে তোলে।
প্রতিটি ভোটের গুরুত্ব বাড়ে, কারণ হারানো ভোটও প্রতিনিধিত্ব পায়।
সংঘাত বা একচেটিয়া ক্ষমতার অপব্যবহারের ঝুঁকি কমে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে P.R. পদ্ধতি:
বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক, সহিংসতা ও আস্থার সংকট প্রায় প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এমন প্রেক্ষাপটে P.R. পদ্ধতি চালুর আলোচনা শুধু সময়োপযোগী নয়, বরং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও শক্তিশালীকরণের জন্য অপরিহার্য। সংবিধান সংশোধন করে অন্তত আংশিক আসনে (যেমন: ৫০% আসনে FPTP, ৫০% আসনে P.R.) পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা যেতে পারে।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনমতই মূল চাবিকাঠি:
তবে এই পদ্ধতির বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা হলো—রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। একচেটিয়া ক্ষমতায় অভ্যস্ত বড় দলগুলো সহজে এমন ন্যায্য ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে আসতে চায় না। তাই নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে গণচাপ তৈরি করা জরুরি।
P.R. পদ্ধতি গণতন্ত্রকে করে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য ও বিশ্বাসযোগ্য। এটি শুধু একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা নয়—এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে প্রতিটি কণ্ঠস্বর শোনা যায়, প্রতিটি ভোটের মূল্য আছে, এবং প্রতিটি নাগরিক নিজেকে রাষ্ট্রের অংশ মনে করে।
আজ সময় এসেছে আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর। আর সেই ভবিষ্যত অনেকটাই নির্ভর করছে—আমরা নির্বাচনকে শুধুই সংখ্যা, না কি ন্যায়ের প্রতিফলন হিসেবে দেখি তার উপর।
মোঃ আব্দুল জাব্বার